মাজিদ আল মামুন, মেহেরপুর-
বেশি মূল্যে পেঁয়াজের বীজ কিনে তা রোপণের পর বর্তমান বাজারে বৈদেশিক পেঁয়াজ (এলসি) আমদানি করায় পেঁয়াজের বাজার মূল্যে ধস নামায় মেহেরপুরের কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি দেশের বাজারে পেঁয়াজের মূল্য ২’শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন তা ২৫/৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়ায় কৃষকদের মাথায় হাত।
মাত্র ২ সপ্তাহ পূর্বেও পেঁয়াজের বাজার দরে কৃষকের মুখে হাসি থাকলেও এখন তা মলিন হয়ে গেছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে তারা দিশেহারা।মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর), সকাল থেকে সন্ধা অবধি মেহেরপুরের টেংরামারী, আশরাফপুর, হরিরামপুর, শ্যামপুর, কালিগাংনী, মাইলমারী, গোপালনগর, রায়পুর, হেমায়েতপুর, রুয়েরকান্দি, মানিকদিয়া, ভোলাডাঙ্গা, রাজাপুর, কোদাইলকাঠি, সিঁদুর কৌটা ও কুমারীডাঙ্গাসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে অধিকাংশ এলাকায় শুধু পেঁয়াজের চাষই চোখে মেলে।
কৃষকদের সাথে আলাপকালে গাংনী উপজেলার মটমুড়া ইউনিয়নের কোদাইলকাঠি গ্রামের জিনারুল ইসলাম, জাইরুদ্দীন ও জাহারুলসহ কয়েকজন কৃষক জানান, এলাকায় প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। বিঘা প্রতি জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করতে খরচ হয়েছে ৮০/১ লাখ ২০ হাজার টাকা। পেঁয়াজের বীজ কেনা হয়েছিল ৮/৯ হাজার টাকা মণ দরে। কিন্তু এখন নতুন পেঁয়াজের বাজার মূল্য প্রতি মণ ১২’শ টাকা। এতে করে খরচের টাকাই উঠবেনা বরং প্রতি বিঘা জমিতে লোকসান গুনতে হবে ৩০/৪০ হাজার টাকা। তিনারা এ ক্ষতি পুষিয়ে দিতে এলসি পেঁয়াজ আমদানি বন্ধসহ ৮০ টাকা পেঁয়াজের মূল্য নির্ধারণের দাবী জানান।
রাজাপুর গ্রামের এমদাদুল হক, ইয়াসিন, রাহাতুল ও আব্দুর রবসহ কয়েকজন কৃষক জানান, বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে লোন নিয়ে পেঁয়াজের চাষ করেছি। কিন্তু এলসি পেঁয়াজ আমদানির কারণে বিরাট লোকসানের মুখে পড়তে হবে কৃষকদের। এসব লোন কিভাবে পরিশোধ করবে এ নিয়ে বিপাকে রয়েছেন তিনারা। তিনারা কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সরকারি সহযোগিতা কামনা করেছেন। একই সাথে এলসি আমদানি বন্ধের জোর দাবী জানিয়েছেন।
ভোলাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক জালাল জানান, গত ১০ মাস ধরে পেঁয়াজ কিনে খেয়েছি ১২০/২০০ টাকা কেজি দরে। পেঁয়াজ রোপণে বিঘা প্রতি জমির ১০ মন বীজ কিনেছি ৯০ হাজার টাকায় কিন্তু পেঁয়াজ উঠানোর সময় এখন আমরা মাস দু’য়েক বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে চাইলেও এখন ২০/২৫ টাকা কেজি। তাহলে এতদামে বীজ কিনে এখন লোকসান পুষিয়ে নেবো কিভাবে? এ ব্যাপারে তিনি সরকারের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য।
একই গ্রামের ছিদ্দিক জানান, সাড়ে ৫ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছি। বিঘা প্রতি জমিতে শুধু বীজ কিনতেই খরচ হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। বিঘাতে সর্বোচ্চ ফলন ৫০ মণ হলেও বিক্রি করে হবে ৬০ হাজার টাকা। তাহলে বাকী ৩৫ হাজার টাকা কোথা থেকে পূরণ করবো।
কৃষক নাজমুল জানান, বেশি মূল্যে সার বীজ কিনে আবাদ শেষে এখন ১২’শ টাকা মণ বিক্রি করে লোকসানই গুনতে হবে।
অপর একজন কৃষক জানান, ৫ কাঠা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করতে বীজ কিনতে হয়েছে ১০ হাজার টাকা মণ দরে। বর্তমান বাজার মূল্যে উৎপাদিত পেঁয়াজ বিক্রি করলে ৭/৮ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে।
সিঁদুরকৌটা গ্রামের কৃষক সাহাজুল ইসলাম জানান, দেড় বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষে শুধু বীজ কিনতেই খরচ হয়েছে ১ লাখ টাকা। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে তোলা যাবে। কিন্তু লোকসান পুষিয়ে নিতে পেঁয়াজের কলিও বিক্রি করছেন। কলি ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও লোকসান তোলা সম্ভব নয়। তিনি সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
অধিকাংশ কৃষক জানান, বিঘা প্রতি জমিতে পেঁয়াজ চাষে বীজ, সার, হালচাষ, কীটনাশক, সেচ কাজ, মজুরী ও পরিবহনসহ খরচ হয়েছে ১ লাখ ৩০/৫০ হাজার টাকা। বর্তমান পরিস্থিতিতে খরচের অর্ধেক টাকাও তোলা সম্ভব নয়। এমতবস্থায় তিনারা আগামী ৩ মাসের জন্য এলসি পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করাসহ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আগামীতে পেঁয়াজ চাষ অব্যাহত রাখতে আর্থিকভাবে সহযোগিতা কামনা করেছেন।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় শীতকালীন পেঁয়াজের চাষ হয়েছে ৪ হাজার ৯’শ ৩৬ হেক্টর জমিতে। প্রণোদনা সহায়তা হিসেবে ৪’শ জন কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে।
যদিও অধিকাংশ কৃষকের অভিযোগ কৃষি বিভাগ থেকে গ্রামের ৩/৪ জন এ প্রণোদনা সহায়তা পেয়েছেন। যা ছিল নিম্ন মাণের। একই সাথে কৃষি বিভাগ থেকে কোনরূপ পরামর্শ না পাওয়ার অভিযোগও একাধিক।
কৃষকরা জানান, বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে কেন। আমরা নিজ পরিকল্পনাতেই খুব ভালো ফলন পাচ্ছি পেঁয়াজে। যদি কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা পাওয়া যায় তাহলে পেঁয়াজ উৎপাদনে তিনারা দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম।