নিজস্ব প্রতিবেদক, তানোর : মালয়েশিয়ায় কৃষক-বিজ্ঞানী সম্মেলনে যোগ দিতে মালয়েশিয়া গেছেন রাজশাহীর তানোরের সেই কৃষিবিদ নূর মোহাম্মদ। সোমবার তিনি মালয়েশিয়ার উদ্যেশ্যো ঢাকা ত্যাগ করেন। শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো সনদ নেই, তবে আছে ধান নিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবন। সংকরায়ণ করে একের পর এক নতুন ধান উদ্ভাবন করছেন তিনি। স্বশিক্ষিত এই বিজ্ঞানীর কাজ আমলে নিয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরাও। ধানগুলো জাত হিসেবে স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছে। তার নাম নূর মোহাম্মদ। তিনি যাচ্ছেন ‘মালয়েশিয়ায় কৃষক-বিজ্ঞানী সম্মেলনে’। সোমবার সন্ধ্যায় তিনি ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে পেস্টিসাইড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (প্যানাপ) তাঁকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। স্থানীয় একটি হোটেলে ৬ নভেম্বর থেকে ৮ নভেম্বর এ্রই সম্মেলন অনুিষ্ঠত হচ্ছে। এ জন্য তাঁকে ৫ নভেম্বর পেনাং শহরে পৌঁছাতে হবে এবং ১০ নভেম্বর পর্যন্ত তাকে সেখানে অবস্থান করতে হবে। আয়োজকেরা তাঁর যাতায়াত, থাকা–খাওয়াসহ সকল খরচ বহন করবে। বাংলাদেশ থেকে তিনিই একমাত্র কৃষক–বিজ্ঞানী হিসেবে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
নূর মোহাম্মদের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া গ্রামে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। বরেন্দ্রভূমিতে প্রায় প্রতিবছরই খরায় নষ্ট হয়ে যায় ধান। সেই ধান রক্ষা করতেই কাজে লেগে যান তিনি। নিজের মাটির ঘরটাকে বানিয়ে ফেলেন গবেষণাগার। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান হেলাল উদ্দিনের সাহচর্য পান নূর মোহাম্মদ। সেখানে হাতে-কলমে শেখেন অনেক কিছু।
এ পর্যন্ত সংকরায়ণের পর নূর মোহাম্মদের কৌলিক সারির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০। সর্বশেষ তিনি একটি নতুন সারি উদ্ভাবন করেছেন। তাঁর দাবি, দেশে প্রচলিত বোরো ধান বপন থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত ১৪০ দিন লাগে। তাঁর উদ্ভাবিত এই ধান বোরো মৌসুমে বপন থেকে ১৩০ দিনের মধ্যে কাটা যাবে। তিনি খরাসহিষ্ণু এই ধানের সারির নাম দিয়েছিলেন এনএমকেপি-৫। এনএমকেপির অর্থ হচ্ছে ‘নূর মোহাম্মদ কৃষি পরিষেবা’। প্রথম দিকে তিনি এনএমটি অর্থাৎ নূর মোহাম্মদ তানোর নামে ধানের নামকরণ করতেন।
এনএমকেপি-৫-এর বিঘাপ্রতি ফলন ২৫ মণ। এই ধানের বিশেষত্ব হচ্ছে, পাকার পরও পাতা সবুজ থাকে। গাছ মজবুত। খরাসহিষ্ণু। পোকামাকড় ও রোগবালাই অনেক কম। এটি রোপা আমন মৌসুমেও হয়। তখন জীবনকাল হয় ১১০ থেকে ১১৫ দিন। এ ধান বোরো মৌসুমে ২৫ মণ ও আমন মৌসুমে ১৮ মণ পর্যন্ত হয়। এই জাতের ধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরুর আগেই ঘরে তোলা যাবে। সাধারণত শেষের দিকে সেচের খরচ বেড়ে যায়। পাম্পেও পানি কম মেলে। প্রথম দিকের চেয়ে পানির পরিমাণও বেশি লাগে। ১০ দিন আগে ওঠার কারণে সেচের খরচ কম হবে। আগাম ওঠার কারণে ভালো বাজার মিলবে। চাল চিকন। ভাত খেতে ভালো।
নূর মোহাম্মদ তাঁর যে পাঁচটি জাত স্বীকৃতি পাওয়ার মতো বলে মনে করেন, সেগুলো হচ্ছে এনএমকেপি-১ থেকে এনএমকেপি-৫ পর্যন্ত। তিনি দেশের প্রচলিত ধানের জাতকে উজ্জীবিত করে তার জীবনকাল কমিয়ে এনেছেন। কোনোটির ফলন বাড়িয়েছেন। খরাসহিষ্ণু জাতের উদ্ভাবন করেছেন। এ ছাড়া আমন মৌসুমের জন্যও তিনি খরাসহিষ্ণু ও স্বল্প জীবনকালের আরও দুই জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। এর একটির নাম দিয়েছেন এনএমকেপি-৫ ও অপরটির নাম দিয়েছেন এনএমকেপি-১০১।
বীজতলায় ফেলা থেকে শুরু করে আমন ১১০ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে কাটা যায়। তবে তিনি জানান, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটও এই জাতের আমন উদ্ভাবন করেছে, কিন্তু তাঁরটা সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য উপযোগী করে এই ধান উদ্ভাবন করেছেন। এই ধান ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত বৃষ্টি না পেলেও খরা মোকাবিলা করে ভালো ফলন দিতে সক্ষম। এর ফলন বিঘায় ২০ থেকে ২১ মণ।
এরপর তিনি সবচেয়ে স্বল্প জীবনকালের খরাসহিষ্ণু বোরো ধান উদ্ভাবন করেছেন বলে দাবি করেছেন। এই ধানের নাম দিয়েছেন এনএমকেপি-১০৩। সুগন্ধি এ ধান আমন মৌসুমেও হয়। কৃষি উৎপাদনে সাফল্যের জন্য নূর মোহাম্মদ ২০০৫ সালে পান রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক। সেরা কৃষি উদ্ভাবন ক্যাটাগরিতে তীর-প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার ২০১৮ পেয়েছেন এই কৃষিবিজ্ঞানী।