শশুরের সম্পদের অনুসন্ধান দাবি,
নাজির শাহীনের হাতে আলাদিনের চেরাগ !
বিশেষ প্রতিবেদকঃ
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা ভূমি অফিসের নাজির (সার্টিফিকেট শাখা) শাহীনুর রহমান শাহীন। তার বাড়ি জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট প্রসাদপাড়া। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,তার বাবার নাম তাসের দেওয়ান। তারা দুই ভাই।তার বাবা মুদি দোকানদার। বাড়ির সামনেই মুদি দোকান। তবে এক সময় তাসের দেওয়ানের তেমন কোনো জায়গা-জমি ছিলোনা।চলায় দায় নুন আনতে পান্থা ফুরায় অবস্থা।ছোট মুদি দোকান থেকেই চলতো সংসার। মুদি দোকন করেই তাসের দেওয়ান পুত্র শাহীনকে পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি বিঘা চারেক জমি করেছেন। শাহীন মাত্র ১০ বছর চাকরি করেই হয়েছেন টাকার কুমির। নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতি করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। গ্রামে করেছেন তিনতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ি। রাজশাহী শহরে করেছেন ৫ তলা ফাউন্ডেশনের বিলাসবহুল বাড়ি। ভাইকে কিনে দিয়েছেন পাওয়ার ট্রিলার। বাবাকে ব্যবসার জন্য মার্কেটের আদলে করে দিয়েছেন বিলাসবহুল দোকান। ব্যাংকে রয়েছে টাকা। এসব সম্পদ অর্জন করতে তিনি করেছেন নানা অনিয়ম-দুর্নীতি। তবে নাজির শাহীনের দাবি দুই কোটি টাকার বাড়ি তার শশুর-শাশুড়ি করে দিচ্ছেন। তার এই দাবির পর তার শশুর-শাশুড়ির বৈধ আয় ও সম্পদের অনুসন্ধানে দুদুকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন গ্রামবাসী।
স্থানীয় সুত্র জানায়, বিগত ২০১৩ সালে রাজশাহী-১ আসনের সাবেক সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরীর সুপারিশে ভুমি অফিসে চাকরি হয় শাহীনুর রহমান শাহীনের। ২০১৪ সালে শিক্ষানবিশ হিসেবে বাগমারা উপজেলা ভুমি অফিসে যোগদান করেন শাহীনুর রহমান শাহীন। চাকরি জীবনের বেশীরভাগ সময় কাটান তানোর ও বাগমারা উপজেলা ভুমি অফিসে নাজির হিসেবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভূমি অফিসে নাজিরের চাকরি পাওয়ার পর শাহিন ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, জাল জালিয়াতিতে বেপরোয়া হয়ে উঠে। অনিয়মই নাজির শাহিনের কাছে নিয়ম। রাজশাহী জেলা উপজেলা আওয়ামী লীগের ছোট বড় নেতাদের সঙ্গে। যোগসাজস করে গড়তে থাকেন সম্পদ। ২য় গ্রেডে চাকরি করেন নাজির শাহিন। উপজেলা ভূমি অফিসে ২য় গ্রেডের চাকরির বেসিক বেতন ৯ হাজার থেকে শুরু করে শেষ হয় ২২ হাজারে। নাজির শাহিনের চাকরির আনুপাতিকহারে বেতন ধরা হয় সব মিলে মাসিক ২০ হাজার টাকা (মূল বেতন পান প্রায় ১৬ হাজার টাকা)। ১০ বছরের তার বেতন দাঁড়ায় ২৫ লাখ টাকা। নাজির শাহিনের তথ্য মতে তিনি মাসে ১০ হাজার টাকা সংসার খরচ করেন। ২৫ লাখ টাকার মধ্যে ১০ বছরে সংসার খরচ বাবদ তিনি ১০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। তার অবশিষ্ট আয় দাঁড়ায় ১৫ লাখ টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাজির শাহিন গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাট প্রসাদপাড়ায় তার নিজ গ্রামে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনতলা ফাউন্ডেশনের একটি একতলা বাড়ি করেছেন। বাড়ির উত্তর পাশে মসজিদের সঙ্গে তার বাবার ছোট মুদি দোকান ছিল। সেখানে জায়গা কিনে প্রায় ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে মার্কেটের আদলে তিনটি দোকানঘর নির্মাণ করেছেন। তার ছোট ভাই আজিজুর রহমান বাচ্চুকে জমি চাষের জন্য আড়াই লাখ টাকা দিয়ে একটি পাওয়ার ট্রিলার কিনে দিয়েছেন। রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়া এলাকার ওমরপাড়ায় জমি কিনে ৫তলা ফাউন্ডেশনের একটি বিলাশ বহুল ৫তলা বাড়ি করেছেন (চারতলা সম্পন্ন, চলছে ৫ তলার কাজ) যার ব্যয় প্রায় দুই কোটি টাকা। ব্যাংকের জমিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। আয় ১৫ লাখ টাকা অথচ তার গ্রামের বাড়ি নির্মাণ, বাবার মার্কেট নির্মাণ ও ভাইকে পাওয়ার ট্রিলার কিনা দেয়াসহ তিনি গ্রামেরই খরচ করেছেন সাড়ে ২৭ লাখ টাকা। বাস্তবতা হলো ১৫ লাখ টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়ি নির্মাণ করাও তার পক্ষে সম্ভব না। সেখানে তিনি খরচ করেছেন সাড়ে ২৭ লাখ টাকা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো নাজিরের চাকরি করে তিনি রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়ার ওমরপাড়া এলাকায় জমি কিনে সেখানে বিলাশ বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। যার ব্যয় প্রায় ২ কোটি টাকা। এখন প্রশ্ন হলো আলাদিনের চেরাগ পেলেও হয়তো অল্প সময়ে এতো অঢেল সম্পদ অর্জন সম্ভব না। নাজির শাহিনের কাছে কি আলাদিনের চেরাপ রয়েছে। এমন প্রশ্নকে সামনে রেখে তার বিষয়ে টানা এক মাস অনুসন্ধান চালানো হয়। এতে বেরিয়ে আসে তার টাকা কামানো আলাদিনের চেরাগের রহস্য। ২০১৪ সালে বাগমারায় শিক্ষানবীশ হিসাবে চাকরিতে যোগদানের পর তিনি অবৈধ পথে টাকা উপর্জন শুরু করেন। বেশ কিছুদিন বাগমারায় থাকার পর তার বদলী হয়। এক সময় তিনি বদলী নিয়ে চলে যান তানোর উপজেলা ভূমি অফিসে। তানোরে যোগদানের পর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগসাজস করে ভুয়া মৎসজীবি সমিতির মাধ্যমে নয়ছয় করে সরকারী পুকুর লিজ, খাস জমি লিজ, মালিকানা জমির খাজনা খারিজে বাধ্যতামূলক ঘুষ রীতি চালু, জালিয়াতি করে সম্পদ গড়তে থাকেন তিনি। এমন কি সরকারী জায়গা পজিশন বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে শাহিনের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাজির শাহিন তানোর উপজেলা ভূমি অফিসে চাকরি করার সময় শুধু পজিশন দেয়ার নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়েছে কোটি টাকা। এ নিয়ে তানোরের গোল্লাপাড়া ও মুন্ডুমালা বাজারের ব্যবসায়ীরা শাহিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেন। একেকজন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিন থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে পরিজশন না দিয়ে শুধু ভুয়া ডিসিআর দেয়া হয়। টাকা নিলেও কোনো ব্যবসায়ীকে তিনি পজিশন বুঝে দেননি। তানোরের সাবেক পৌর মেয়র ইমরুল হকের সঙ্গে যোগসাজস করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কালিগঞ্জ হাটে সরকারি জায়গা জালিয়াতি করে আলামিন নামে ব্যক্তির নামে করে দেন নাজির শাহিন। তানোরে রয়েছে প্রায় ৯শ’টি সরকারী পুকুর। নামে বেনামে সমিতি করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আতাত করে লিজ দেন শাহিন। আর সেখান থেকেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। মূলত তানোরের ভূমি অফিসে তিনি খাজনা খারিজের একটি নিয়ম চালু করেছিলেন। এক দলিলে এক বিঘা জমি থাকলে খাজনা বা খারিজ করতে তাকে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা দিতে হতো। খাজনা খারিজের জন্য ৫০ হাজার টাকা রেট বেধে দেয় নাজির শাহিন। একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে তানোর উপজেলা প্রশাসন শাহিনকে বাদলী করে বাগমারা উপজেলা ভূমি অফিসে পাঠায়। বাগমারায় বদলী হওয়ার পর তার দৌরাত্ম্য আরো বেড়ে যায়। তানোরের রীতিনীতি তিনি বাগমারার মানুষের উপর প্রয়োগ শুরু করেন।
জানা গেছে, বাগমারার বাইগাছা গ্রামের ওসমান সোনার ১৯৭৯ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে আজিজুর রহমান, তার ছেলে মন্টু সরকার, প্রতিবেশি জব্বাস আলীর প্রায় দুই একর জমি কিনেন। দীর্ঘদিন পর আজিজুরের ছেলে মুন্টু দাবি করে বসেন ওই জমি ওসমান সোনার জাল দলিল করে নিয়েছেন। এ নিয়ে আদালতে মামলা হয়। এ মামলায় বাদি মুন্টুর জেল হয়। মুন্টু ওই জমির খাজনা বাতিলের জন্য বাগমারা উপজেলা ভূমি অফিসে আবেদন করেন। আর এই আবেদনকে পুঁজি করে নাজির শাহিন নিজের পুঁজি বৃদ্ধি শুরু করেন। জানা গেছে, তৎকালীন বাগমারার সহকারী কমিশনার (ভূমি) জোবায়ের হাবিব এই জমি বিষয়টি নিয়ে দুইপক্ষের সঙ্গে বসে মিমাংসা করে দেন। দলিলপত্র পর্যাললোচনা করে সহকারী কমিশনার জানতে পারেন জমিটির প্রকৃত মালিক ওসমান সোনার। এ নিয়ে এসিল্যান্ড নাজিরকে ওসমান সোনারের পক্ষে রায় দেয়ার নির্দেশ্য দেন। এই রায় দেয়ার জন্য ওসমান সোনারের কাছে শাহিন মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। পরে তাকে ২৫ হাজার টাকা দেন ওসমান। তারপরও তিনি রায় দিতে গড়িমশি করেন। দিনের পর ঘুরে গত ১৮ নভেম্বর ওসমান সোনার তার ভাতিজাকে নিয়ে পুনরায় নাজির শাহিনকে রায়ের ব্যাপারে বলেন। এসময় নাজির শাহিন জানান জমির মূল দলিল নিয়ে আসলে রায় লিখে দেয়া হবে। পরে গত ২১ নভেম্বর পুনরায় তারা ভূমি অফিসে গেলে ওসমানের বিপক্ষে রায়ের কাগজ ধরিয়ে দেন শাহিন। রায়ের তারিখ দেখানো হয়েছে ১১ সেপ্টেম্বর-২৪। অথচ তিন দিন আগেও ওসমান সোনার তার কাছে গেলে শাহিন মূল দলিল দেয়ার কথা বলেন। ভুক্তভোগি ওসমান সোনারের প্রশ্ন তিনদিন আগেও শাহিন জানালেন মুল দলিল না থাকায় রায় লেখা হয়নি, সেখানে তিনদিনের মধ্যে তিনি দলিল ছাড়াই কি করে রায় লিখলেন? ভুক্তভোগি ওসমান সোনার বলছেন, মোটা অংকের টাকা নিয়ে নাজির তার প্রতিপক্ষ মুন্টুর পক্ষে রায় দিয়েছেন। শুধু ওসমান নয়, বাগমারায় এমন শতশত মানুষের জায়গা জমি নিয়ে নয়ছয় করেছেন শাহিন। শুধু তাই নয়, সাবেক সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সাক্ষর জাল করে ওসমানের জমি প্রতিপক্ষের পক্ষে রায় দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তবে সহকারী কমিশনারের দুটি কাগজে দুই ধরনের সাক্ষর পাওয়া যায়। নাজির পূর্বের তারিখ দিয়ে সহকারী কমিশনারের সাক্ষর জাল করে রায়ের কপি তৈরি করেছেন। খোদ বাগামরার সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) জোবায়ের হাবিবও তার সাক্ষর নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছেন। তিনি বলছেন, এটা সুক্ষ জালিয়াতি। তিনি বর্তমান মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে কর্মরত। এছাড়াও বাগমারায় রয়েছে ৮৪৯টি সরকারী পুকুর। এক সময় এমপি এনামুল হক ও পরে এমপি কালামের সঙ্গে যোগসাজস করে সরকারী পুকুর লিজ দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নাজির শাহিন। এমপি কালামের ইন্ধনে তাহেরপুরের অনেক হিন্দুদের জমি নয়ছয় করে মোটা অংকের টাকা কামিয়েছে নাজির শাহিন। বিষয়টি নিয়ে নাজির শাহিনুর রহমান শাহিনের সঙ্গে কথা বলা হয়। প্রশ্ন করা হয় বেতনের টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়ি করাই সম্ভব না, তাহলে তিনি দুই কোটি টাকার বিলাশ বহুল বাড়ি কিভাবে করলেন। এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, দুই কোটি টাকার বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন আমার শ্বশুর-শ্বশুড়ি। তিনি কোনো অবৈধ টাকা ইনকাম করেন না বলে দাবি করেন।
পরে খোঁজ নেয়া হয় শাহিনের শ্বশুর বাড়ি চাঁপাইনবাগঞ্জে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওদাপাড়া বহুতল ভবন নির্মাণের সময় সামান্য কিছু টাকা শাহিনকে ধার দিয়েছেন তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তাকে দুই কোটি টাকা দেয়ার যে কথা বলছে তার কোনো তথ্য কেউ দিতে পারেননি।
এদিকে স্থানীয়রা জানান, যারা মেয়ের জামাইকে দুই কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি করে দেয়।তাদের বৈধ আয় ও সম্পদের বিষয়ে দুদুকের অনুসন্ধান সময়ের দাবি।
বিষয়টি নিয়ে বাগমারার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাহিদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলা হলে তিনি বলেন, আমি মাত্র ২ মাস আগে এসেছি। আমি থাকার সময় কেউ কোনো দুর্নীতি করতে পারেনি। শাহিন যে দুর্নীতি করেছেন সেটা আগের এ্যাসিল্যান্ড থাকার সময়। পুর্বের এ্যাসিল্যান্ডের সাক্ষর জালের বিষয়ে তিনি বলেন, সাক্ষর জাল করা গুরুতর অপরাধ। লিখিত অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এব্যাপারে বাগমারা উপজেলা নির্বাহ কর্মকর্তা ইউএনও মাহবুবুল ইসলাম জানান, নাজিরের বিষয়টি আমি জানি না। তিনি যদি ঘুষ, দুর্নীতি বা অনিয়মের সাথে জড়িত হয় তাহলে খোঁজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এব্যাপারে রাজশাহী জেলা দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার সর্তে বলেন, নাজির শাহিন তানোর ও বাগমারায় ব্যাপক দুর্নীতি করেছে। এমন অভিযোগ তারা আগেই জেনেছেন। নাজির শাহিনের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে বলেও জানান তিনি।