রাবি প্রতিনিধি:
২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ট্রাক চাপায় নিহত হোন গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহবুব হাবিব হিমেল। এদিন রাতে বিভিন্ন দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাস বাংলাদেশ মাঠে শিক্ষার্থীদের সাথে উন্মুক্ত আলোচনায় আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে হিমেলের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন রাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার। কিন্তু হিমেলের পরিবারকে দেওয়া সেই আশ্বাস এখনো পূরণ করতে দেখা যায়নি রাবি প্রশাসনকে। ফলে অর্থ কষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছে হিমেলের পরিবার।
বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেছিলেন, ‘হিমেলের পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে। তার মা যতদিন জীবিত থাকবেন তার সার্বিক দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিচ্ছে। তিনি যেন তার জীবদ্দশায় কোন কষ্ট না পান সেজন্য বড় একটি তহবিল তাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’ কিন্তু বাস্তবে কিছুই করতে দেখা যায়নি হিমেলের পরিবারের জন্য।
শিক্ষার্থী ও হিমেলের সহপাঠীদের সূত্রে জানা যায়, নিহত হিমেলের পরিবারকে এককালীন ৫ কোটি ও প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েও কিছুই পূরণ করেনি বিগত প্রশাসন। কেবল আশ্বস্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন হিমেলের পরিবারকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে দুবার ৫ লাখ করে মোট ১০ লাখ টাকা সহযোগিতা পেয়েছেন হিমেলের পরিবার; এছাড়া আর কোনো সহযোগিতা পাননি তারা।
এছাড়াও হিমেলের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ২০ তলা বিজ্ঞান ভবনের নাম করণ করা হবে বলে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেছিলেন তৎকালীন ভিসি— যা এখনও ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। এদিকে, এ দূর্ঘটনায় আরেকজন আহত শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনের ব্যয়ভার ও মোটরসাইকেলের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন; কিন্তু সেই শিক্ষার্থীর ব্যয়ভার ও মোটরসাইকেলের ক্ষতিপূরণও দেয়নি রাবি প্রশাসন।
এদিকে, হিমেল মারা যাওয়ার প্রায় তিন বছর অতিবাহিত হলেও তার পরিবারকে দেওয়া আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়নি রাবি প্রশাসনকে।
কিভাবে চলছে এখন হিমেলের পরিবার? এ বিষয়ে খোঁজ নিলে জানা যায়, হিমেলের মা মনিরা আক্তার রোড অ্যাক্সিডেন্টে মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত একজন রোগী; এজন্য নিয়মিত ঢাকায় ট্রিটমেন্ট নিতে হয় তাকে। প্রতিদিন মোটা অংকের টাকার মেডিসিন লাগে টাকার অভাবে অনেক সময় মেডিসিন কিনতেও পারেন না। অর্থের অভাবে ঠিকভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছেন না তিনি; এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের কাছে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন হিমেলের মা।
হিমেলের মায়ের মস্তিষ্কের অপারেশন করার জন্য মোটা অংকের টাকা প্রয়োজন; সেজন্য আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার আশায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তারের সাথে দেখা করেন তিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে টাকা নেই এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোন সহযোগিতা পাননি জানিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন তৎকালীন উপাচার্য। ফলে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাকে।
হিমেলের মৃত্যুর ঘটনায় আহত হয়েছিলেন তার বন্ধু রায়হান। তিনি জানান, “হিমেলের পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। আন্টি আমাকে প্রায়ই ফোন দেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্থিক সহযোগিতার নিয়ে দেওয়ার জন্য। সবকিছু বাদ দিয়ে ৩০-৩৫ লাখ টাকা দিবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল রাবি প্রশাসন; কিন্তু কিছুই দেয়নি। টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাকে। অনেক সময় টাকার অভাবে মেডিসিন কিনতেও পারেন না তিনি। আন্টি যেন এখন স্বচ্ছলভাবে চলতে পারেন সেদিকে একটু নজর দেওয়ার জন্য বর্তমান প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
এ বিষয়ে হিমেলের মামা খন্দকার আবু বকর মুন্না বলেন, “আমার বোনের চোখে ছানি পড়ায় তার দুই চোখে অপারেশন করতে হয়েছে। এছাড়াও রোড এক্সিডেন্টে মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়ায় প্রতিমাসে ঢাকায় যেতে হয় তাকে। দু’পায়ে বাতের ব্যাথা সহ নানা রোগে জর্জরিত আমার বোন। হিমেলের মৃত্যুর সময় রাবি প্রশাসন বিভিন্নভাবে আর্থিক সহযোগিতা করবেন বলে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন; এখনও পর্যন্ত ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন। গত তিন মাস আগে আর্থিক সহযোগিতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে গিয়েছিলাম; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর কোনো সহযোগিতা করতে পারবেন না বলে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হিমেলের মা মনিরা আক্তার বলেন, “আমার অপারেশনের জন্য অনেক টাকা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আর্থিক সহযোগিতা কামনা করছি।”
হিমেলের পরিবারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন,”বিগত প্রশাসন ঠিক কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটা আমাদের কাছে পরিস্কার নয়। হিমেলের পরিবার থেকে আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে আবেদনের কোন ফাইল এখনো পর্যন্ত আমার দপ্তরে আসেনি। আসলে নথিপত্র দেখে আমরা যথাসাধ্য সাহায্যের চেষ্টা করব।”
উল্লেখ্য , মঙ্গলবার(১ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টার দিকে শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে দুর্ঘটনায় গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহবুব হাবিব হিমেল নিহত হন। তিনি শহীদ শামসুজ্জোহা হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। এছাড়া তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ড্রামা এসোসিয়েশনের (রুডা) সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের দফতর সম্পাদক ছিলেন।